শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত বছরের ৪ আগস্ট (৩৫ জুলাই) উত্তাল ছিল সারাদেশ। এদিন শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে সরকারদলীয় কর্মী ও পুলিশ যৌথ দমন অভিযান চালায়। সারাদেশে অন্তত ৯৩ জন নিহত হয়। এদিন প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে অসহযোগ আন্দোলনে হতাহতের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে কর্মসূচিটি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়।
রাজধানীর শাহবাগে বিকাল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের দলীয় ক্যাডারদের রাস্তায় নামিয়েছে। যদি আমার ভাইদের বুকে গুলি করা হয়, যদি আমার বোনেরা আবার আহত হয়, তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। যেখানেই আঘাত আসবে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সেনাবাহিনীকে তাদের নামের সঙ্গে ‘দেশপ্রেমিক’ শব্দটির মর্যাদা রক্ষা করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি দেশবাসীকে রাজপথে নামার আহ্বান জানান। ১ আগস্ট এক দফার ডাক দেওয়া তারেক রহমান এদিন ভিডিও বার্তায় বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কও এদিন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এতে শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া চালুর আহ্বান জানানো হয়। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সেই প্রস্তাবে বলা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সেই সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
এদিন হাইকোর্ট আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো বন্ধের আবেদন জানিয়ে করা একটি রিট খারিজ করে দেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে নিহতদের মরদেহ নিয়ে মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিল শাহবাগ থানার সামনে পৌঁছানোর পর পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে।
৪ আগস্ট সকাল কিছুটা শান্ত থাকলেও দুপুরের দিকে মাঠে নামে সরকারদলীয় সমর্থকরা। তখনই শুরু হয় সহিংসতা। অন্তত ২০টি জেলায় সরকারপন্থি কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বিরোধী দলের আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এদিন পর্যন্ত ৩১১ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও বার্তায় বলেন, এক হাজারের বেশি আন্দোলনকারীকে সরকার হত্যা করেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। শাহবাগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া ও পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১০-এ পুলিশ ও অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ কর্মীরা গুলিবর্ষণ করে।
সরকার আবারও দেশব্যাপী কারফিউ জারি ও ফোর-জি মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ৫ আগস্ট থেকে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঘোষণায় বলা হয়, রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা সদর, উপজেলা সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও শিল্পাঞ্চলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বলবৎ থাকবে। তবে এ ঘোষণার পরও চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, রংপুর, ময়মনসিংহ, জয়পুরহাট ও ভোলায় আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এর আগে ১৯ জুলাই মধ্যরাতে সরকার প্রথম অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করেছিল, যা মাঝেমধ্যে শিথিল করা হয়েছিল। ৪ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘অবৈধ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’-এর নিন্দা জানায়।






