নির্বাচনকে নিয়ে দুয়েকটি পক্ষ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে: সালাহউদ্দিন আহমদ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, সবার মধ্যে ঐক্য ফাটলের একটা চেষ্টা কোনো না কোনো পক্ষ নিচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যার জন্য আমরা তর্ক করছি, বিতর্ক করছি, সংস্কারের জন্য আলাপ-আলোচনা করছি, কিন্তু নির্বাচনকে নিয়ে যেন দুয়েকটি পক্ষ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে।’

আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ‘রাষ্ট্রীয় মদদে মানবতাবিরোধী অপরাধের কৌশল উন্মোচন’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমদ এসব কথা বলেন। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এই সেমিনারের আয়োজন করে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারগুলো প্রণয়ন করছি এবং এই পরিবেশটা বাংলাদেশে অতীতে কল্পনাও করা যেত না। সব রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে—রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার চাই। সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের মধ্য দিয়ে শক্তিশালীভাবে নির্মাণ করতে চাই। তার মধ্যে আছে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ ও সংসদ এবং সবার ওপরে থাকবে ফ্রিডম অব প্রেস। বাকি রইলো গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা।’

তিনি বলেন, ‘ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য এ দেশের মানুষ দীর্ঘ ১৬ বছর সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে। অনেকগুলো অধিকারের মধ্যে প্রধানতম অধিকারের দাবি ছিল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যখন একটা রাস্তা সুগম হয়েছে, এই রাস্তায় যেন আমরা কোনো কাঁটা না বিছাই—এই আহ্বান সব রাজনৈতিক দলের কাছে রাখব।’

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্যই তো আমরা বিগত এক বছর অনেক আলাপ-আলোচনা এবং সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’ নির্বাচন নিয়ে সংশয় থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘আমরা এমন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করব যার মধ্য দিয়ে অতীতের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করবে। যদি আমরা ভালো, আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে চালু রাখতে পারি, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ফ্যাসিবাদী সব চর্চা, অতীতের সব ইতিহাস ধুয়ে মুছে যাবে।’

গুম নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমার ছবিটা আজকে ওখানেই থাকার কথা ছিল— ফটো নিয়ে স্বজনরা ওখানে বসে আছেন। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ফটো না হয়ে আজকে আমি এখানে জিন্দা আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। আমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই সেই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি এখনো। আয়নাঘর, কেন যেন নেত্র নিউজ নাম দিলো, সেটা সবার মনে লাগে গেল এবং এটা গ্রহণযোগ্য হয়ে গেল, কিন্তু আয়নাঘরে তো আয়না নেই! আয়নাঘরে যমদূত ছিল, আয়নাঘরে মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল, সেই আয়নাঘরে আমরা ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আজকের এই অধিবেশনে গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের কেউ নতুন করে যোগদান করেননি। এটা একটা সুসংবাদ। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দিনের রাজনীতিবিদরা যেন এটা নিশ্চিত করে, ভবিষ্যতে যেন গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের কাউকে এ রকম কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হতে হয়। আসলে সে জন্যই অনবরত সংগ্রাম করে যাচ্ছি আমরা—গণতন্ত্রের সংগ্রাম।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ‘আমি একজন রাজনৈতিককর্মী হিসেবে আপনাদের সামনে এই কথা বলতে পারি, যদি জনগণ আমাদেরকে ম্যানডেট দেয়, ইনশাআল্লাহ, গুম প্রতিরোধের জন্য, গুমের সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রথমেই আমাদেরকে যা যা করতে হয়: আইন প্রণয়ন এবং সেটা কার্যকর করার জন্য, সব কিছু করা হবে। আমরা সেই বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছি, যে বাংলাদেশে কোনো দিন ঘুমের শিকার হয়ে কোনো ব্যক্তিকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না।’

তিনি বলেন, ‘সারাদেশে ১ হাজার ৮৫০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যাটা অবশ্য এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধীনে আছে। এক সময় হয়তো একটু কম-বেশি হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৩ হাজারের বেশি। এভাবে হেফাজতে মৃত্যু, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড—সব কিছু যোগ করে সেই সংখ্যাটা আগে ছিল সাত হাজার ১৮৮, এখন সেটা বেড়ে আরও অনেক বেশি হবে। এ রকম একটা বিভীষিকাময় অবস্থায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটা চলেছে।’

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যারা এই কাজটা করে গেছে, তাদের কিন্তু এখনো অনুশোচনা নেই। তারা এখনো তাদের অপরাধের স্বীকার তো দূরের কথা, উল্টো গণঅভ্যুত্থানকারীদের অপরাধী হিসেবে নামকরণ করছে। এরপরও বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো তাদেরকে রাজনীতিতে আহ্বান করতে পারবে? বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে? ক্ষমা তো চায়নি! আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অপেক্ষা করছি।’

সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি। এতে বক্তব্য দেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান, মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিএনপি নেতা হুম্মাম কাদের চৌধুরী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব।

এতে আরও বক্তব্য দেন গুমের শিকার বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা, বিএনপির সহ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সহকারী সদস্যসচিব নাসরীন সুলতানা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দপ্তর সম্পাদক সালেহ উদ্দিন সিফাত প্রমুখ।

  • Related Posts

    ‘চুপ থাকো, তোমার জন্য এসব হয়েছে’, আদালতে মতিউরকে স্ত্রী

    দুর্নীতির মামলায় ছাগলকাণ্ডের আলোচনায় আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান এবং তার স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান লায়লা কানিজের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।…

    ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে: প্রধান উপদেষ্টা

    প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটি হবে জাতির নবজন্মের মহোৎসব। আজ রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *