গণতান্ত্রিক যাত্রায় হুমকি হতে পারে উগ্রবাদ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আসে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়Ñ ভোটবিহীন নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে। আর নির্বাচনকেই গণতান্ত্রিক পথে ফেরার একমাত্র উপায় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উগ্রপন্থি তৎপরতা গণতান্ত্রিক প্রত্যাবর্তনকে সংশয়ে ফেলেছে। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা দেশের রাজনীতিতে মধ্যপন্থা ও উদারপন্থার পরিবর্তে উগ্রবাদের আবির্ভাবের লক্ষণ দেখছেন। আর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রধান বাধা হতে পারে উগ্রবাদী রাজনীতি। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে শর্তহীনভাবে ভোটের পথে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। নির্বাচন না হলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধিক উদারতার সুযোগ নিয়ে দেশে উগ্রবাদী রাজনীতির চর্চা বেড়ে চলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে আইন ও শাসনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের বিচারকের ভূমিকায় আবির্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষকে। তা ছাড়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে কোথাও কোথাও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের জবাবদিহির আওতায় না এনে এটাকে উসকে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এসব ঘটনা যত বাড়বে, ততই রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা নির্বাচন ভ-ুলের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে একটি পক্ষ ধোঁয়াশা তৈরি করছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভোটাধিকারের দাবিতে গত ১৬ বছর দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দাবি ছিল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই রাস্তা সুগমও হয়েছে। এখন সেই রাস্তায় যেন আমরা কাঁটা না বিছাই। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধার সৃষ্টি হবে অথবা নির্বাচন ভ-ুলের পাঁয়তারা হবে। সেভাবে কেন দেখব? এই রোডম্যাপ ঘোষণার জন্যই তো আমরা সবাই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এক জায়গায় এসেছি। কোনো বিষয়ে যদি সংশয় থাকে, আলাপ-আলোচনা করে গণতান্ত্রিক যাত্রাকে সুগম করতে পারি।

তবে এতটা সরলভাবে দেখতে রাজি নয় জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) রোডম্যাপও ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে জুলাই সনদ নিয়ে একদিকে বিএনপি, আরেকদিকে জামায়াত-এনসিপির নেতৃত্বে রাজনীতিতে দুটি বলয় তৈরি হয়েছে। জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো পিআর পদ্ধতির বিষয়ে অনড়। এনসিপি জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়ে

এক চুলও ছাড় দিতে চায় না। কিন্তু বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো পিআর পদ্ধতি ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক প্রাধান্যের পক্ষে না। দুই শিবিরের এমন অবস্থানের কারণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। যদিও সরকার এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

তবে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিরোধিতাকে অতটা গুরুত্ব দেই না। এটা তাদের আসল কথা নয়। তারা তো ভেতরের কথা বলছেন না। দলগুলো দরকষাকষিতে ব্যস্ত। সেই কথা তো তারা বলছেন না। তারা তো প্রকাশ্যে নির্বাচন বয়কট করার মতো অবস্থানে যায়নি। এমনকি সেই কথাটাও স্পষ্ট করে বলেননি। অন্যদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতিও তারা নিচ্ছে। কাজেই আমি এটাকে বড় করে দেখছি না। তবে এটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা দরকারÑ যেন দলগুলো মনে না করে যে তাদের কোনো গুরুত্ব নাই এই সরকারের কাছে। সেদিকে না যাওয়াই উত্তম।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংশয়, মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধপূর্ণ অবস্থান এবং সরকারের অতিনমনীয়তার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা ইস্যুতে ভিন্নমত দমনের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় ‘জীবন মহল’ নামের একটি বিনোদন পার্কে তৌহিদি জনতার ব্যানারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ’৭১ মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের আলোচনাসভায় একদল লোক মব তৈরি করে আলোচনাসভা ভ-ুুল করে। এর পর সেখান থেকে রাজনৈতিক নেতা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কয়েকজনকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এর দুই দিন আগে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে কতিপয় মানুষ মব তৈরি করে। এ ছাড়াও সম্প্রতি ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়ি, দোকানপাটে হামলা চালনো হয়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে দেওয়া হয় কয়েক শ মাজার, দরগা শরিফ। এর বাইরে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা মেটাতে নানা কায়দায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার লক্ষণ এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নির্বাচনকেই টনিক মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলে উগ্রবাদী শক্তি টিকবে না। তাই রোডম্যাপকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি। তিন বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেকে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তাদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। এ সুযোগে বিভিন্ন শক্তি নির্বাচনকে বিলম্ব করতে চায়। আবার আধিপাত্যবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও চাইবে একটা দুর্বল সরকার থাকুক। এসব কারণে কেবল নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য নতুন নতুন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু সামনে আনা হয়।

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, উগ্রবাদী শক্তি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে আছে। আমরা মনে করি তাদের একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব আছে। তাই তাদের বিকল্প রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিকল্প অর্থনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু বিগত দিনে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা অনেক সময় আইনের মধ্য দিয়ে দমন করতে চেয়েছে। অভ্যুত্থানের পরে অনেক দক্ষিণপন্থি শক্তি সামনে চলে এসেছে। তারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা যদি গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে পারি, তারা বাংলাদেশে পাত্তা পাবে না।

তবে নির্বাচন প্রশ্নে দলের অস্পষ্ট অবস্থানের কথাই ব্যক্ত করলেন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। তিনি বলেন, রোডম্যাপে শুধু বিএনপি খুশি হয়েছে। পিআর পদ্ধতি ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য হতে হবে। দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে থাকব, কর্মসূচি দেব। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৌহিদি জনতার নামে ঘটা ‘মব ভাওয়ালেন্স’কে জামায়াত সমর্থন করে না বলে জানান এই নেতা। তিনি বলেন, এটা (মব) আমরা সমর্থন করি না। আমরা তো ন্যায্যতার জন্য সংগ্রাম করেছি। কারও অপরাধ থাকলে সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে।

ইসির রোডম্যাপ ঘোষণা ইতিবাচকভাবে দেখলেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (্এনসিপি)। দলটির দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এখনও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার উপায় নির্ধারণ করা হয়নি। জুলাই সনদ চূড়ান্ত না করে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল।

নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান, আরেকদিকে মব সন্ত্রাসের আড়ালে উগ্রপন্থার উত্থান এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিÑ এসব কিছুই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এখনই সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। এই পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রত্যাবর্তনের জন্যই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের পথে হাঁটার জন্য যথাসময়ে ািনর্বাচন অনুষ্ঠান একমাত্র উপায় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা

  • Related Posts

    লন্ডনে মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টা, গণসংহতি আন্দোলনের নিন্দা

    লন্ডনে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। আজ শনিবার…

    উপদেষ্টা মাহফুজের ওপর হামলার চেষ্টার ঘটনায় নাহিদের হুঁশিয়ারি

    লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফজু আলমের ওপর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার চেষ্টার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য না আসায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *