তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগেই যন্ত্রপাতির মেয়াদ শেষ

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে স্থাপিত যন্ত্রপাতির একাংশের ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মেয়াদ শেষের পথে রয়েছে আরও কিছু যন্ত্রাংশ। ফলে এসব যন্ত্রের ত্রুটি মেরামতে অর্থ খরচ করতে হবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক)। তা ছাড়া দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় এসব যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে টার্মিনাল চালু করতে না পারায় নতুন করে হাজার কোটি টাকা গচ্চার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টার্মিনাল চালুর আগেই বাকি যন্ত্রগুলোর ওয়ারেন্টিও শেষ হয়ে যাবে। সেগুলো মেরামত করতে তখন অতিরিক্ত ব্যয় হবে সরকারের।

২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকে অনুমোদন পায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (ফেজ-১)। এর মধ্যে তৃতীয় টার্মিনালের ৯৯.৮৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। নানা জটিলতার কারণে তৃতীয় টার্মিনাল চালু করতে পারছে না বেবিচক। কবে নাগাদ চালু করা যাবে, তাও অনিশ্চিত।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হলেও ক্যালিব্রেশন ও টেস্টিং বাকি। টার্মিনালের পূর্ব অংশের কাজ শেষ হয়নি। এ ছাড়া টার্মিনাল পরিচালনার জন্য জাপানের চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি এখনও সম্পাদিত হয়নি।

ওই চুক্তি হওয়ার পর জনবল নিয়োগের প্রয়োজন হবে। জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টা টার্মিনাল সচল রাখতে কমপক্ষে ছয় হাজার জনবল লাগবে। এ ছাড়া নিরাপত্তার জন্য অন্তত চার হাজার জনবল দরকার হবে। নিয়োগের পর এই জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতেও সময় লাগবে। এমন অবস্থায় তৃতীয় টার্মিনাল চালুর সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকলে শুধু প্রতিস্থাপনের খরচই নয়, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে যাত্রীসেবায় বিলম্ব হবে এবং দেশের বিমান চলাচল খাতে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে বেবিচক সদস্য (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মাহবুব খান বলেন, আমরা প্রায়শই যন্ত্রপাতিগুলোকে সচল রাখতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করি। কী পরিমাণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। থার্ড টার্মিনাল দ্রুত চালু করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

যন্ত্রাংশের ওয়ারেন্টি শেষ : টার্মিনাল চালু না হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে আরও আগে। বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ২০ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত

অবস্থায় পড়ে আছে। কয়েকটির মেয়াদ এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। বাকিগুলোরও ওয়ারেন্টি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এতে যন্ত্রগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বেবিচক সূত্র বলছে, টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ধাপে ধাপে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও আংশিক ইনস্টল করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল সময়মতো কমিশনিং ও পরীক্ষামূলক চালনা। কিন্তু নানা কারণে কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় যন্ত্রগুলো হয় গুদামে পড়ে আছে, নয় তো চালু হয়নি। ফলে ওয়ারেন্টির আওতায় বিনা খরচে মেরামত বা যন্ত্রাংশ বদলের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ না করে বলেন, আগে যন্ত্রপাতির ত্রুটি চুক্তি অনুযায়ী বা বিনা খরচে মেরামত হতো, এখন অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন করে সাপ্লায়ার বা স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এতে বেবিচকের বিপুল অঙ্কের অতিরিক্ত ব্যয় হবে।

তৃতীয় টার্মিনালের রানওয়েতে বাতি সরবরাহকারী এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৬০ কোটি টাকা মূল্যের বাতি সরবরাহ করা হয়েছে, যেগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। দীর্ঘদিন অলস পড়ে থেকে বাতিগুলোর কার্যক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে : বেবিচকের নথিপত্র থেকে জানা যায়, অব্যবহৃত যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম, ব্যাগেজ স্ক্রিনিং সিস্টেম, নিরাপত্তা পরীক্ষার সরঞ্জাম, ফ্লাইট ইনফরমেশন ডিসপ্লে সিস্টেম, ভিজ্যুয়াল ডকিং গাইডেন্স সিস্টেম, কমন ইউজ প্যাসেঞ্জার প্রসেসিং সিস্টেম, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ইন্টিগ্রেটেড বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক, ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, সিসিটিভি, মাস্টার ইলেকট্রিক ক্লক, কেবল টিভি সিস্টেম, অ্যাক্সেস কন্ট্রোল, টু-ওয়ে রেডিও, অপটিক ফাইবার ক্যাবল, স্ট্রাকচার্ড ক্যাবলিং ইত্যাদি। যন্ত্রভেদে এসবের ওয়ারেন্টি ১২ মাস থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।

স্থাপিত যন্ত্রের মধ্যে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিষ্কাশন পাম্প, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, নিরাপত্তা অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সিস্টেম ও ল্যান্ডস্কেপিংয়ের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। অন্যদিকে গ্লেজিং, কম্পোজিট প্যানেল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্টোন, উঁচু মেঝে সিস্টেম, রোলার শাটার, সম্প্রসারণ জয়েন্ট, সিলিং সিস্টেম, সাইনেজ কাজ ও আলোকসজ্জার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে।

বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম ও দ্বিতীয় টার্মিনালে দিনে ৩০টির বেশি উড়োজাহাজ সংস্থার ১২০ থেকে ১৩০টি উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব উড়োজাহাজের প্রায় ২০ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল ব্যবহার করেন। এই হিসাবে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরও ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *