৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত দুশ্চিন্তায় কর্মকর্তা ও আমানতকারীরা দায়ীদের শাস্তির আওতায় না আনায় সমালোচনা

দেশের আর্থিক খাতে আবার বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে একসঙ্গে ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তে। এতে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আমানতকারীরা। এসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় না আনারও সমালোচনা শুরু হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এ পদক্ষেপ এবং সবার আগে তাদের আমানত ফেরত দেওয়া হবে। অর্থনীতিকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং যাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পথে গেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে আমানকারীদের টাকা ফেরত ও কর্মীদের প্রাপ্য সুবিধা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফাস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, ফেয়ারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, অ্যাভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে গভর্নরের সম্মতি নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অবসায়নে (লিকুইডিশন) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে তথ্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়নে সরকারের ৯ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন-২০২৩ অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা, দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা এবং মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। ৭(২) ধারা অনুযায়ী, লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়। গত ২২ মে এসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না আসায় অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘৯টি প্রতিষ্ঠান লিকুইডেট করার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে মত দিয়েছে। আমরা এটা করছি শুধু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। তাদের স্বার্থই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।’

তবে দীর্ঘসময় ধরে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা আটকে থাকায় আমানতকারীদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ অবসায়নের সিদ্ধান্তে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তারা। পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী মশিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানটিতে ১৮ লাখ টাকা জমা রেখেছিলাম। এই টাকা আটকে পড়ায় অভাব-অনটনের মধ্যে দিন চলছে। এতদিনে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলতে পেরেছি। এখন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের আমানতের কী হবে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. শাহরিয়ার সিদ্দিকী আমাদের সময়কে বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটা এখনও পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। সরকার থেকে টাকা পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে যা কিছু হবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করেই।

বেশি দুশ্চিন্তায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা : জানা যায়, একসঙ্গে ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বেন। এতে তাদের পরিবারগুলোয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ আরও বেড়ে যাবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এমনিতেই চাকরির বাজার মন্দা। এর মধ্যে হঠাৎ চাকরি চলে গেলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়বেন। ভবিষ্যতের চিন্তায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলেও কর্মীদের চাকরি যাবে না বলে আশ^স্ত করেছিলেন গভর্নর। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন কোনো বক্তব্য দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে এখনও আসেনি। আমার মত হলো- এগুলোকে বন্ধ করা হলে আমানতকারীদের স্বার্থ যেমন দেখতে হবে, তেমনি বিদ্যমান জনবলের বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার। তা না হলে একসঙ্গে অনেক কর্মী বেকার হবেন। এতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। তাদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো চিন্তা করেছে কি না জানি না, তবে দায়দায়িত্ব তাদের ওপরই আসবে।

দায়ীদের বিচারের আওতায় না আনায় সমালোচনা : বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট বারবার ফিরে আসার অন্যতম কারণ দায়ীদের শাস্তি না হওয়া। অনেক সময় প্রভাবশালী পরিচালক, ঋণখেলাপি কিংবা রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুরবস্থার জন্য দায়ী থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত না করে এই ৯ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সমালোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমেও।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত পরিচালক বিষয়টি নিয়ে নিজস্ব ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেন। নজরুল ইসলাম নামের ওই কর্মকর্তা সেখানে লেখেন- ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সাথে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত না করে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করা ঠিক হবে না। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে এর সাথে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা দরকার। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়নি। অথচ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।

তার শেয়ারে সহমত প্রকাশ করে রাসেল আহমেদ সাজিদ নামের একজন মন্তব্যে লেখেছেন- প্রকৃত যারা অপরাধী তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। খেলাপিরা কি দেশের আইনেরও ঊর্ধ্বে। এভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় না এনে উল্টো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত। এতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।

  • Related Posts

    দাম বাড়ল সয়াবিন তেলের

    দাম বাড়ল সয়াবিন ও পাম তেলের। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ছয় টাকা বাড়ানো হয়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের…

    সংসদে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব বাদ দেওয়ার পরামর্শ সিপিডির

    উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিভিন্ন দুর্বলতার কথা তুলে ধরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একইসঙ্গে বিদ্যমান এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থাকেই আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *