সাড়ে পাঁচ মাসের নির্বাচনী পথনকশা

সাড়ে পাঁচ মাস সময় হাতে রেখে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে সাড়ে তিন মাসের প্রস্তুতি শেষে আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং এর দুই মাস পর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথামর্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ইসি বলেছে, আগামী রমজান শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ভোটগ্রহণ করা হবে। সে হিসাবে আগামী ১০ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি হতে পারে ভোট। সাড়ে পাঁচ মাসের এই নির্বাচনী যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ দেখা যাবে আগামী রবিবার ৩১ আগস্ট। এদিন সম্পূরক খসড়া ভোটার তালিকা চূড়ান্ত এবং নির্বাচনী আইন ও বিধি প্রণয়ন সম্পন্ন করা হবে। এরপর ধাপে ধাপে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন চূড়ান্ত, চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, নির্বাচনী সরঞ্জম সংগ্রহসহ ২৪টি কর্মপরিকল্পনা সমাপ্ত করা হবে। এই রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাঁচ মাস ১৫ দিনের নির্বাচনী যাত্রা শুরু করল ইসি।

গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ এই রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এতে ভোটের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করলেও আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রমজান শুরুর এক সপ্তাহে আগে ভোটের দিন নির্ধারণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসি।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘ভোটগ্রহণের ৬০ দিন আগে তফসিল দেব। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলেছে আগামী রমজানের আগে ভোট করার জন্য। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু। আবার রমজান শুরু চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। এভাবে আপনি নির্বাচনের তারিখ বের করতে পারেন।’

ইসি সচিবের এই বক্তব্যে ১০ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই নির্বাচনী যাত্রায় ২৪টি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি ।

নির্বাচনি আইন ও বিধি : রোডম্যাপে বলা হয়েছে- নির্বাচনসংক্রান্ত সব আইন ও বিধি সংশোধন ও প্রণয়ন করা হবে ৩১ আগস্টের (আগামী রবিবার) মধ্যে। এ ছাড়া সংসদী আসনের সীমানা নির্ধারণ আইন সংশোধন, ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, সংসদ নির্বাচনের ভোটা কেন্দ্র নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সংবাদিক নীতামালা চূড়ান্ত, নির্বাচন পরিচালনা (সংশোধন) ২০২৫ প্রতীকসহ, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯১, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন-২০০৯ এগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে, যা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ : নির্বাচন সামনে রেখে দুই ধাপের সম্পূরক খসড়া ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হবে ৩১ আগস্ট। আর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ নভেম্বর। এর জন্য খসড়া প্রকাশ হবে ১ নভেম্বর। হালনাগাদের পর বর্তমানে দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ জন। নতুন বিধান অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারাও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাই ভোটের আগে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ নভেম্বরে।

অংশীজনের সাথে ইসির সংলাপ : সংসদ নির্বাচন শুরুর আগে অন্যান্য বারের মতো এবারও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এ জন্য সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সংলাপ শুরুর সম্ভাব্য সময় রেখেছে ইসি। প্রায় দেড় মাস ধরে চলবে এই সংলাপ।

নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন : আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় দেড় শতাধিক নতুন দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় টিকে থাকা ২২টি দলের মাঠপর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদন ৩১ আগস্টের মধ্যে জমা দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার ১৪৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। সবগুলো দলের তথ্য ঘাটতি থাকায় ঘাটতি তথ্য পূরণের জন্য সময় দিয়েছিল ইসি। নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে টিকে রয়েছে মাত্র ২২টি দল। এই ২২ দলের মধ্যে চূড়ান্ত নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যারা টিকে থাকবে, তাদের চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়া হবে ৩০ সেপ্টম্বরের মধ্যে।

৩০০ সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ : সংসদীয় আসনগুলোর সীমানা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলমান। খসড়া সীমানার ওপর গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ৩৩ জেলার ৮৪টা আসন সম্পর্কিত ১ হাজার ১৮৫টি আপত্তি এবং ৭০৮টি পরামর্শ বা সুপারিশের ওপর আলোচনা শেষ হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে ১৫ সেপ্টম্বরের মধ্যে সংসদীয় আসনের চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করা হবে।

দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন : আগামী নির্বাচনে বিপুলসংখ্যাক দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার আগ্রহের কথা ইসিকে জানিয়েছে। ইসি জানিয়েছে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন ২২ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত করে ১৫ নভেম্বর নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হবে। বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমতি প্রদানে যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করা হবে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে।

নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহ ও বিতরণ : নির্বাচনের সকল প্রকার মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণ কার্যক্রম শেষ করা হবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এর মধ্যে অমোচনীয় কালি, ব্যালট বাক্স, সিল, প্যাডসহ যাবতীয় সরঞ্জাম থাকবে।

ভোটের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা : নির্বাচনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। যদিও ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে। ইসি সচিব বলেছেন, আইনশৃঙ্খলার অংশ দেখবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম সভা হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য কার্যবলী গ্রহণ করবে ধাপে ধাপে। নির্বাচনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে ৩১ অক্টোবর।

পোস্টার, ম্যানুয়েল, নির্দেশিকা প্রকাশ : নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি ম্যানুয়েল, নির্দেশিকা, পোস্টার ইত্যাদি মুদ্রন শেষ করা হবে ১৫ সেপ্টেম্বর মধ্যে। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ২৯ আগস্ট থেকে ভোটগ্রহণের চার থেকে পাঁচ দিন আগে যাবতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করবে ইসি।

প্রবাসী ও অভ্যন্তরীণ প্রবাসীদের পোস্টার ব্যালট : আগামী নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকছে। এ জন্য যেসব প্রবাসী দেশ-বিদেশে ভোটার রয়েছেন, তাদের জন্য ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে পোস্টাল ব্যালটে ভোটের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করার পরিকল্পনা করেছে ইসি।

প্রচার ও তথ্য প্রযুক্তি প্রস্তুতি : ১৫ নভেম্বর মধ্যে নির্বাচনী তথ্য প্রচারের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি মন্ত্রণালয়, টিঅ্যান্ডটি, বিটিআরসিসহ বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সঙ্গে সভা করবে ইসি। ৩১ অক্টোবরের আইসিটি সংক্রান্ত সব কাজ শেষ করা হবে। ইসি সচেতনতামূলকা প্রচারকাজ শেষ করতে চায় ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। এ ছাড়া টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা, ফলাফল কীভাব প্রকাশ ও প্রচার করা হবে, বেসরকারি ফলাফল প্রচার সংক্রান্ত কার্যক্রম নির্ধারণ, সেসব কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।

অন্যান্য প্রস্তুতি : ব্যবহার উপযোগী স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সংগ্রহের কাজ চূড়ান্ত করা হবে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বাজেট চূড়ান্ত করা হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বরে মধ্যে। নির্বাচনের জন্য জনবল ও প্রশাসনিকব্যবস্থা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় ইসি।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *