সংসদ অকার্যকর থাকার সুযোগে সচিবালয়ের সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়ে দুর্নীতির মচ্ছব করেছেন সংসদ সচিব মো. মিজানুর রহমান- এমন অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। মাত্র সাড়ে তিন মাসের দায়িত্বকালে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ও নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
সংসদ থাকলে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও হুইপদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় সংসদ সচিবালয়। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর যেহেতু সংসদ অকার্যকর, তাই উন্নয়নকাজ থেকে শুরু করে সব কাজের তদারক করেন সংসদ সচিবালয়ের সচিব। যদিও স্পিকারের যাবতীয় ক্ষমতা আইন উপদেষ্টার ওপর ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সংসদ সচিবালয়ে তার একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়েই কাজ করানোর
পরিকল্পনা থেকে ২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মিজানুর রহমানকে এনডিসি (৫৯২৪) সংসদ সচিবালয়ের সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়। তিনি সংসদ সচিবালয়ে যোগদান করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। যোগদান করেই কর্মকর্তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনকে লক্ষ্য করে কাজ করার নির্দেশ দেন। গেল বছর ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংসদ ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগামী সংসদ বসার আগেই এসব অফিস মেরামত করার গুরু দায়িত্ব পড়ে সংসদ সচিবালয়ের। সংসদ অকার্যকর থাকায় এ দিকে নজর না থাকার সুযোগটা নেন মিজানুর রহমান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সচিব মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাসা বরাদ্দে কোনো অনিয়ম হয়নি। অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। যথাযথ নিয়ম অনুসারে করা হয়েছে এখানে অনিয়ম বা দুর্নীতির সুযোগ নেই। আমার সময়কালে পিএবিএক্স সংক্রান্ত কোনো ফাইল প্রক্রিয়া করা হয়নি। তাই অনিয়মের সুযোগ নেই।
সাড়ে তিন মাস দায়িত্বকালীন তিনি যত ধরনের অনিয়ম আছেন তার সবই করেছেন। তার জন্য প্রতিদিন ডাব, সংসদ বাগানের ফল, রাতের খাবারসহ যাবতীয় জিনিস হাজির করতে হতো। এ ছাড়া তার দায়িত্বকালীন যে কয়টি কাজ হয়েছে, প্রতিটি কাজের বিল পাসের সময় ৫-১০ লাখ টাকা অর্থ নেওয়ার অভিযোগ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতেও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সংসদ সচিবালয়ের টেলিফোন ক্রয় খাতে বরাদ্দ করা টাকা থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান টেসিস কোম্পানির মাধ্যমে পিএবিএক্স সেট ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু টেসিস সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই সেখান থেকে আর্থিক সুবিধা না থাকায় সেই টেন্ডার বাতিল করেন মিজানুর রহমান। তার এই অনিয়মের সহযোগী ছিলেন সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (সেবা শাখা) কফিল উদ্দিন মাহমুদ। সচিব মিজানুর রহমান পিএবিএক্স ক্রয়ের জন্য কমিশন চাইলে কফিল উদ্দিন মাহমুদ জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রয় করলে কিছু পাওয়া যাবে না। এ জন্য তিনি রি-টেন্ডারের পরামর্শ দেন এবং নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রয়ের কথা বলেন। তার যুক্তি অনুযায়ী সেই টেন্ডার বাতিল করে রি-টেন্ডার করেন মিজানুর রহমান। এরপর পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে ১০% নগদ নিয়ে সেই কাজ দেওয়ার চুক্তি করেন। শুধু পিবিএক্স ক্রয়ের কাজের জন্য তিনি পান ১৫ লাখ টাকা। বিষয়টি অন্য কর্মকর্তাদের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা আইন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক খোঁজখবর নিয়ে তাকে তাৎক্ষণিক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় গত ১৫ জুন।
পিএবিএক্স সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব (সেবা শাখা) কফিল উদ্দিন মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, সংসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পিএবিএক্স সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করা হয়। টেসিস যে প্রাক্কলন দিয়েছিল, সেটা বেশি মনে হয়েছে। এ ছাড়া উনারা সার্ভে না করেই প্রাক্কলন দেয়। এখানকার পুরনো ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলেননি। সচিব স্যার (মিজানুর রহমান) বলেন ওনারা বিস্তারিত না বললে এই কাজ করতে পারব না। এ ছাড়া উপদেষ্টা পর্যায়ে এটার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি। এটার কোনো টেন্ডার হবে না। টেসিস প্রাক্কলন কম দিয়েছিল কি না- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালের চেয়ে কম আছে। তবে আগের প্রাক্কলন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম দিয়েছে। সচিব স্যার করেননি। এখন উপদেষ্টা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হবে। তবে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি- এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, মিটিং হয়নি, নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়নি। বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। সংসদের নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে। কাজেই সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে তিনি সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসা বরাদ্দের নীতিমালা ভঙ্গ করে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছামতো বরাদ্দ দিয়েছেন। বাসার ধরন অনুযায়ী ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কর্মকর্তাদের বাসা বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী আবেদনের তালিকায় ৩৬ জনের মধ্যে ২৮তম ছিলেন সহকারী নিরাপত্তা পরিদর্শক কাজী তৌহিদুজ্জামান। তাকে শেরেবাংলা নগরের ভবন ই-১০ এর ডি টাইপ বাসা বরাদ্দ দেন অর্থের বিনিময়ে।
এ ছাড়া আবেদনের তালিকায় ৫৬ জনের মধ্যে ৩৮তম ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী নিরাপত্তা পরিদর্শক মো. মাহবুবুল আলমের নামে পশ্চিম আগারগাঁও সি-টাইপ বাসা সি-১/১৫০২ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও আর্থিক লেনদেন করেন বলে জানা গেছে। তার ধারাবাহিকতায় সচিবের অঘোষিত ক্যাশিয়ার আওয়ামী লীগের দোসর ঠিকাদার জয়নাল আবেদীন। যিনি সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) ও সহকারী নিরাপত্তা পরিদর্শক কাজী তৌহিদুজ্জামান (রাজু) মিলে ২৯টি বাসা বরাদ্দ দেন। এই বাসাগুলো বরাদ্দে তিনি ৩০-৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বরাদ্দ দিতে না পারায় অর্থ ফেরত দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তারা লিখিতভাবে আইন উপদেষ্টাকে জানালে তিনি তাৎক্ষণিক ১২টি বাসা বরাদ্দের আদেশ বাতিল করেন। কিন্তু আরও ১৭টি বাসা, যেগুলো আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বরাদ্দ দিয়েছিল, সেগুলো সেভাবেই রয়েছে। এ জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তার অব্যাহতি চেয়ে আইন উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। সেই লিখিত অভিযোগে উপসচিব থেকে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা ১৪৫ জন স্বাক্ষর করেন।
বাসা বরাদ্দের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে রাব্বী হাসান নামের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আমি এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। আরও ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিল। দিতে পারিনি। পরে সেই বাসা অন্যজনের কাছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়েছে। আমার টাকা ফেরত দিয়েছে। সচিব স্যার যখন দায়িত্বে ছিলেন তিনি কোনো ফাইলই টাকা ছাড়া স্বাক্ষর করতেন না। জানা গেছে, মিজানুর রহমানের সময় সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আগারগাঁওয়ের ১৫তলা দুটি আবাসিক ভবনে ১১২টি ফ্ল্যাটের সুপেয় পানির গভীর পাম্প ক্রয়ের টেন্ডার করেন। সেখানে নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়া রি-টেন্ডার করান। তিনি আর্থিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-বদলি করেছেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে প্রেষণে বদলি করে সংসদ সচিবালয়ে নিয়ে আসেন।
মো. মিজানুর রহমান, এনডিসির আগে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের নিবন্ধক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী কমিশনার ভূমি ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ছিলেন। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ১৬ জুন তিনি অবসরে যান।






