শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্ব শূন্যতা নাকি সামাজিক অস্থিরতা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের হামলা- সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গন এখন অস্থির সময় পার করছে। বুয়েট থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে। বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যতা ভরাট হচ্ছে হঠাৎ ফুঁসে ওঠা ক্ষোভ, নানা ধরনের আন্দোলন ও বহিরাগত প্রভাব দিয়ে। এর সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্ষমতার অভাবও দেখছে কেউ কেউ, যার খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক টানাপড়েনও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রতিফলিত হচ্ছে, যা সংঘাতকে আরও বিস্তৃত করছে। আবার পরিকল্পিতভাবেই দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় উত্তেজনা উসকে দেওয়া হচ্ছে- এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ।

ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আবদুর রব আমাদের সময়কে বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও গবেষণার স্থান। সেখানে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের কোনো স্থান নেই। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করা যাবে না। আবার সংঘর্ষও সমাধান নয়। সমস্যার সমাধান আসতে হবে সংলাপ, স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। আমরা আহ্বান জানাই শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশ করবে, কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষ থাকবে, আর রাষ্ট্র শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে।’

ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য স্থানে যে গণ্ডগোলটা হলো, যদি সেখানে ছাত্র সংসদ থাকত তাহলে দ্রুত সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। সেখানে কেউ কাউকে মানে না। শিক্ষকদের মানে না। ছাত্ররা একেকজন একেক রকম কথা বলছেন। তারা পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। ওই সব জনগণেরও নেতৃত্ব নেই, যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। ছাত্র সংসদ নেই, স্থানীয় সরকার নেই, জাতীয় সংসদ নেই- থাকলে ওই সব নেতারা দ্রুত সমাধান করে ফেলতে পারতেন। কাজেই এসব জটিলতা নিরসনে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দরকার, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার।

ঘটনার শুরু বুয়েট দিয়ে। গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি আদায়ে হঠাৎ রাজধানীর শাহবাগ অবরোধ করেন। তারা ওই দিন শাহবাগ থেকে হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এরপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করে। ৩১ আগস্ট অবশ্য বুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। গতকাল সোমবারও বুয়েট ক্যাম্পাস ছিল অনেকটাই ফাঁকা। শিক্ষার্থীদের আনাগোনাও ছিল কম।

বুয়েটের রেশ না কাটতেই রবিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব বিভাগের পরীক্ষা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। গতকালও থমথমে ছিল চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়। চট্টগ্রামে এই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য প্রান্তের আরেক বড় ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, হাতাহাতি, কোষাধ্যক্ষ কার্যালয় অবরোধসহ উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিও এখন থমথমে। এর মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সেখানে গত রবিবার একই দিনে পৃথক দাবি আদায়ে উপাচার্যসহ ২২৭ শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে রাতে বহিরাগতরা এসে হামলা করে শিক্ষার্থীদের ওপর। এ নিয়ে উত্তপ্ত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রবিবার রাতে অনির্দিষ্টকালের জন?্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি সব শিক্ষার্থীকে গতকাল সকাল ৯টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। গতকালও ক্যাম্পাস উত্তপ্ত ছিল। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই হল ছাড়তে অস্বীকার করেন। বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় উপাচার্যের ক্ষমা চাওয়াসহ ছয় দফা দাবিতে সাড়া না মেলায় গতকাল বিকাল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড় এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেন তারা। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান আমাদের সময়কে বলেন, সামনে যেহেতু নির্বাচন কোন কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে তো আকাক্সক্ষা থাকেই। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। পাশাপাশি পুলিশসহ অন্যান্য স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। সবকিছু মিলিয়ে সবাইকে সবার সহযোগিতা করাটা জরুরি। তিনি বলেন, নির্বাচন ঘিরে কেউ কেউ তো চাইবেই অস্থিরতা তৈরি করতে। সেগুলো মাথায় নিয়েই সব সময় একটা পূর্ব প্রস্তুতি থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে ইউজিসির কোনো ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, এখন যেসব বিশ^বিদ্যালয়গুলো স্পর্শকাতর, সেই জায়গায় বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। কারণ, শিক্ষকদের পক্ষে এ ধরনের সংকট মোকাবিলা করা সব সময় সম্ভব হয় না।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. ওবায়দুল করিম আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন সমাজ শক্তি তাদের স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত থাকে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এই সুযোগ কাজে লাগায়। অপরাধী ও মাফিয়াচক্র সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সিভিল সোসাইটির অংশ হচ্ছে ছাত্র সংসদগুলো। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি, গণতন্ত্রের ভিত্তি সিভিল সমাজের গণতন্ত্রের এই অভিযাত্রা বানচাল করতে চায়। ফলে বিভিন্ন ছুতা খুঁজে এই সন্ত্রাসীরা প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ বেশ দুর্বল। তবে আমি বিশ্বাস করি, এমন অবস্থা ফরাসি বিপ্লবের পরও হয়েছিল। সময় লাগলেও সব গণতন্ত্রকামী শক্তির ঐক্য দরকার।

নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় : অন্য দিকে গতকাল সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে এবং সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনগণের সমন্বয়ে গত রবিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্থানীয় প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে এই কমিটি কাজ করবে।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *