রানার আর ছুটে চলে না ডাকবাক্সও খোলে না

এক সময় সারাদেশের পথে-ঘাটে লালরঙা ডাকবাক্সের দেখা মিলত। দূরবাসী আপনজনের সঙ্গে নানা বার্তা আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম ছিল ডাক। ডাকবাক্সে তাই জমা হতো অসংখ্য মানুষের আবেগ, অপেক্ষা আর ভালোবাসার গল্প। প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী বানে ভেসে গেছে সেই সময়। এখন খুব কমই চোখে পড়ে ডাকবাক্স। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও নিঃসঙ্গ, ধুলায় ধূসর। কেউ আর এগুলোতে চিঠি ফেলে না। ডাকবাক্সও তাই আর খোলে না। প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে রানারের ছুটে চলা সেই সব দিনও।

মাত্র দুই যুগ আগেও মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম ছিল চিঠি। হাতে লেখা সেই চিঠির প্রতিটি অক্ষরে থাকত ভালোবাসা, অপেক্ষা, আকুলতা আর অনুভবের ছাপ। দূরে থাকা প্রিয়জনের খোঁজ জানতে হলে বা নিজের মনের কথা জানাতে হলে কাগজ-কলমই ছিল অন্যতম ভরসা। চিঠি আসবে ভেবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করত মানুষ। ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টা শুনলেই হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে যেত। আজ সে চিত্র কেবলই স্মৃতি। কারণ প্রযুক্তির প্রবল ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়েছে এই আবেগকে। চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন, ই-মেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিডিওকলের মতো দ্রুতগামী মাধ্যমগুলো। এখন আর কাউকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। এক ক্লিকে কথা, ছবি, এমনকি চোখের দেখা পর্যন্ত হয়ে যায়। যোগাযোগের এই সহজতা যেমন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গতি এনেছে, তেমনি চিঠির ধৈর্য, আবেগ ও সৌন্দর্যকে অনেকটাই নিঃশেষ করে দিয়েছে।

অন্যদিকে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বার্তা প্রেরণ হয় দ্রুত, তবে এর মাঝে থাকে না সেই গভীর অনুভব। মেসেঞ্জারে মুছে গেছে হৃদয়ের আবেগ যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে। একটি ভয়েস নোট বা ইমোজি সহজে পাঠানো যায় বটে, কিন্তু তা কখনও হাতে লেখা একটি চিঠির বিকল্প হতে পারে না। চিঠির মাধ্যমে গড়ে উঠত পারস্পরিক সম্পর্কের একটি নরম সেতুবন্ধ। মা-ছেলের, প্রেমিক-প্রেমিকার, বন্ধু কিংবা প্রবাসী আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগে যে মানবিকতা কাজ করত, তা আজকের দ্রুতগতির যোগাযোগে অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। প্রিয়জনের অপেক্ষায় প্রহর গোনা মানুষ ছুটে আসে না দরজার কাছে। পোস্টম্যানের দিকে চেয়ে থাকে না আশাভরা চোখে। আধুনিকতার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সেই সব দিন।

বাংলাদেশের ডাক বিভাগ এক সময় ছিল যোগাযোগের প্রধান বাহক। শহর হোক বা প্রত্যন্ত গ্রাম, প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ডাকঘর আর পোস্টম্যানদের মাধ্যমেই চলত যোগাযোগ। ‘চিঠি’ ছিল অন্যতম আশ্রয়, যেখানে মানুষ তাদের আনন্দ, দুঃখ, প্রেম বা অপেক্ষার গল্প লিখে পাঠাত দূরের প্রিয়জনের

কাছে। সাদা কিংবা হলুদ খামে মোড়া সেই শব্দগুলোর ছিল আত্মা, ছিল অনুভব। আর সেসব পৌঁছে দিত ‘রানার’ বা গ্রামবাংলার পরিচিত ডাকপিয়ন। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে ‘রানার’ শুধু চিঠি নিয়ে আসত না, সে ছিল খবরের বাহক, ভালো-মন্দের সংবাদদাতা। এক সময় এমন হতোÑ একটি চিঠি পেয়ে পুরো পরিবার বা প্রতিবেশীরা জড়ো হতো, অনেকে কান পেতে শুনত কী লিখেছে দূরের কেউ।

ডাকঘর এখন অনেকটাই ফাঁকা। যেখানে আগে প্রতিদিন শত শত চিঠি আসত, এখন মাসে মাত্র কয়েকটা চিঠি জমা পড়ে। ডাকবাক্সগুলো মরিচা পড়া লাল রঙের নিঃসঙ্গ স্মারক যেন, যেগুলো কেউ আর ছুঁয়েও দেখে না। শহরের কেন্দ্রগুলোয় কিছুটা চাহিদা থাকলেওÑ গ্রামের ডাকঘরগুলো অনেকটাই অচল। পোস্টম্যানরাও এখন আগের মতো ছুটে চলেন না। তাদের অনেকেই এখন শুধু সরকারি পত্র, নোটিশ বা কোর্টের চিঠি বিলি করেন।

ডাক বিভাগ কি তবে শুধুই ইতিহাস? উত্তরে বলা যায়Ñ না। ডাক বিভাগ এখনও টিকে আছে, তবে অনেকটাই রূপান্তরের মাধ্যমে। এখন ডাকঘরে পাসপোর্ট বিতরণ, ই-কমার্স ডেলিভারি, মোবাইল ব্যাংকিং (নগদ) ইত্যাদি সেবা চালু হয়েছে। চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে পার্সেল ও অনলাইন অর্ডার। তবে সাধারণ চিঠি বা ব্যক্তিগত পত্রালাপের সেই আবেদন আর নেই। সরকার ডাক বিভাগকে আধুনিকায়নের নানা উদ্যোগ নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার মূলসত্তা চিঠির আবেগ, মানুষের সঙ্গে সংযোগ তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না ডাকবাক্স কীভাবে কাজ করে, রানার কে ছিল, কিংবা হাতে লেখা চিঠির মূল্য কী। তরুণ প্রজন্ম জানেই না কীভাবে এক সময় একটি চিঠি বদলে দিত জীবনের মোড়। ফলে সংবেদনশীলতা, অপেক্ষা, ভাষার সৌন্দর্যÑ এসব অনেকটাই বিলীন। ‘রানার ছুটে চলে না, ডাকবাক্সও আর খোলে না’Ñ এই বাক্যটি শুধু একটি বাস্তবতার চিত্র নয়, এটি এক যুগের অবসানের প্রতীক। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি আমরা হারিয়েছি এক অপূর্ব আবেগ, এক ধরনের মানবিক সংযোগ। ডাকবাক্স হয়তো আর আগের মতো ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু তা ইতিহাস, আবেগ এবং মানবিক সংযোগের এক অনন্য প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল। যদিও চিঠি এখন প্রায় অচল, তবু ডাকবাক্সকে কি শুধু ইতিহাসের পাতায় রাখাই যথেষ্ট? অনেক দেশে পুরনো ডাকবাক্সগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে স্মারক হিসেবে। বাংলাদেশেও তা করা যেতে পারে। বিশেষ কিছু এলাকায় ঐতিহ্য হিসেবে এগুলোকে রাখা, সংস্কার করা এবং তথ্যবহুল প্ল্যাকার্ড দিয়ে সেগুলোর ইতিহাস জানানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি লেখার চর্চা চালু রাখা, বিশেষ দিবসে ‘হাতের লেখা চিঠি উৎসব’ আয়োজন করা গেলে হয়ত নতুন প্রজন্ম ডাকবাক্সের গুরুত্ব বুঝবে।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *