মর্যাদার লড়াইয়ে বন্ধ লেখাপড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা আন্দোলনকারীদের # সাত দফা দাবিতে অনড় ডিপ্লোমাধারীরাও

বাংলাদেশের প্রকৌশল অঙ্গনে ফের ছড়িয়ে পড়েছে অস্থিরতা। ‘মর্যাদা’ রক্ষার দাবিতে দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা এবং সব একাডেমিক কার্যক্রম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা। এর মধ্যে বুয়েট স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন লেভেল ও টার্মের সব পরীক্ষা আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিতের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে।

অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ ডিপ্লোমাধারীরাও পাল্টা কর্মসূচি শুরু করেছেন। তারাও এখন সাত দফা দাবি আদায়ে অনড় অবস্থান নিয়েছেন।

দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ‘কমপ্লিট শাটডাউন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ বলবৎ রাখার ঘোষণা দিয়েছে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এটি বলবৎ থাকবে। চলমান আন্দোলন ও দাবির বিষয়ে সবিস্তারে তুলে ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে একত্র হওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানে প্ল্যাটফর্মের সভাপতি মো. ওয়ালি উল্লাহ বলেন, আন্দোলনটা আমাদের তিন দফার ওপর চলছিল এবং গতকালের যে ম্যাসিভ ইনসিডেন্ট হয়েছে, এগুলোর সুরাহা হতে হবে। আমাদের যদিও কমিটমেন্ট দেওয়া হয়েছিল গতকাল, কিন্তু আজও এর কোনো বাস্তবায়ন পাইনি। পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন বলবৎ থাকবে। এ ছাড়া চলতি সপ্তাহে বিভাগীয় সম্মেলন এবং পরবর্তী সপ্তাহে জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।

‘প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন’ গত বুধবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কর্মসূচি পালন করা হয়। দফাগুলো হচ্ছে- এক. নবম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদে কেবল পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে এবং ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং হতে হবে; দুই. দশম গ্রেডে বর্তমানে শুধু ডিপ্লোমাধারীরা আবেদন করতে পারেন, সেখানে উচ্চ ডিগ্রিধারীদের আবেদন করার সুযোগ রাখতে হবে এবং তিন. শুধু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্নকারীরাই যেন ‘প্রকৌশলী’ বা ‘ইঞ্জিনিয়ার’ পদবি ব্যবহার করতে পারেন, সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

অন্যদিকে বিএসসি শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামার পর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ ডিপ্লোমাধারীরাও পাল্টা কর্মসূচি শুরু করেছেন। তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে অন্যতম হলো দশম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পদ কেবল ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা এবং পদোন্নতিতে ৩৩ শতাংশ কোটা বহাল রাখা।

প্রকৌশলী পেশার মর্যাদা নিয়ে টানাপড়েন নতুন নয় বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা অসন্তোষ। শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে সমমর্যাদা চান, ডিপ্লোমাধারীরা শঙ্কিত বেকার হওয়ার ভয়ে। সমাধানহীন প্রতিটি দিন শুধু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে; রাষ্ট্র হারাচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রকৌশলীরা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদের শিক্ষাজীবন যদি বারবার আন্দোলনে ব্যাহত হয়, তবে দেশীয় শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি ঘাটতি তৈরি হবে। শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের প্রত্যাশা- সরকার দ্রুত, সুস্পষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত নেবে যাতে দেশের প্রকৌশল শিক্ষা ও পেশায় স্থিতি ফিরে আসে।

উচ্চপর্যায়ের কমিটির বৈঠক

প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ দিতে গঠিত কমিটির প্রথম সভা ছিল গতকাল। এ দিনের সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।

সচিবালয়ে বৈঠক শেষে কমিটির প্রধান ও জ¦ালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, একদিকে তিন দফা দাবি, আরেক দিকে সাত দফা। আমরা নিরপেক্ষতার সঙ্গে কারও পক্ষপাতিত্ব না করে এ সমস্যার একটা ন্যায্য সমাধান করার চেষ্টা করব। সরকার এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আন্দোলন করে লাভ নেই।

কমিটির সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, যেসব সমস্যা এসেছে, সেগুলো আজকের নয়, বহুদিন আগের সমস্যা। তাই এগুলোর সমাধান করতে হলে সবার সঙ্গে আমাদের পরামর্শ করতে হবে। সে জন্য আমরা একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ করেছি। সেই ওয়ার্কিং গ্রুপে মোট ১৪ জন প্রতিনিধি থাকবেন। যে সংস্থাগুলোতে ইঞ্জিনিয়ার রিক্রুট করা হয়, সেই সংস্থা প্রধানরা এ কমিটিতে থাকবেন। একই সঙ্গে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের থেকেও চারজন প্রতিনিধি থাকবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে সেখানে।

এদিকে বিএসসি ডিগ্রিধারীদের দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করছে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলী আকবর সরকার বলেন, একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়াররা অযাচিত আন্দোলন করছেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জিএম সাদিকুল ইসলাম বলেন, বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা যদি যোগ্য হন, তাহলে কেন তাদের দশম গ্রেডে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে না? একজন যদি নবম গ্রেডে চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে, ১৩তম গ্রেডের পরীক্ষা দিতে পারে, তাহলে দশম গ্রেডে কেন পারবেন না?

কোনো ধরনের কোটা নয়, বরং মেধার ভিত্তিতেই চাকরির নিয়োগ হওয়া উচিত বলে অভিমত দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মেধার ভিত্তিতেই চাকরির নিয়োগ হওয়া উচিত। পদোন্নতি পরীক্ষার মাধ্যমে হোক। যার যোগ্যতা থাকবে, সে সুযোগ পাবে।

চুয়েটেও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন

চুয়েট প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়, তিন দফা দাবিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরাও। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চুয়েট ক্যাম্পাসে কোনো বিভাগেই ক্লাস বা পরীক্ষা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত অবস্থায় দাবি আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যান।

ডিসি মাসুদের কুশপুত্তলিকা দাহ

রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড় সড়কে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অবস্থান নিয়ে এক ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলমের কুশপুত্তলিকা পোড়ান।

ডিসিকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে : ডিএমপি

এদিকে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা একটি ছবির মাধ্যমে রমনার ডিসি মাসুদ আলমকে নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করছে ডিএমপি। গতকাল ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাসুদ আলমকে নিয়ে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এক ছাত্রের মুখ চেপে ধরার একটি ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কে বা কারা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই ছবি বা পরীক্ষা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত অবস্থায় দাবি আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যান।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *