চবিতে সংঘর্ষের নেপথ্যে মব করে বাগছাস, সুযোগ নেয় যুবলীগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় নতুন তথ্য সামনে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রথমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) নেতারা মব তৈরি করতে ঘটনাস্থলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পর সুযোগ নেন জোবরা গ্রামের যুবলীগ নেতা মো. হানিফ ও তার অনুসারীরা।

শিক্ষার্থীদের দাবি, দারোয়ানকে মারধরের অভিযোগ ঘিরে বাগছাস নেতারা উত্তেজনা ছড়ান। তারা শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধভাবে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। ঠিক সেই সময় হানিফের লোকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে যোগ দেয়। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর রামদা নিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন, গুরুতর তিনজন লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। পরে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর করে গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

বাগছাসের কেন্দ্রীয় সংগঠক ও চবি শিক্ষার্থী রশিদ দিনার বলেন, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি ছোট ছিল। কিন্তু মাশনূন ও তার অনুসারীরা শিক্ষার্থীদের জড়ো হতে উৎসাহিত করে, যা তুচ্ছ ঘটনাকে বড় সংঘর্ষে পরিণত করেছে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত শাখা ছাত্রদল নেতা শাফায়াত জানান, বাগছাসের মাসনূন প্রতিটি হলে হলে শিক্ষার্থীদের ডেকে গেছে। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্ত তারা মানেনি। আমরা থামানোর চেষ্টা করলে তারা আমদেরকে ‘হিজড়া’ বলে স্লোগান দেয়। চবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইছিলাম। কিন্তু কয়েকজন অযথা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনের ব্যর্থতাও স্পষ্ট। তাদের কারণে এতগুলো শিক্ষার্থীকে মার খেতে হয়েছে।

সহকারী প্রক্টর নাজমুল হোসেন বলেন, দ্বিতীয় দিনে আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে আলোচনার পর ৩৪ ছাত্রকে নিরাপদে বের করে আনার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কয়েকজন ছাত্র প্রক্রিয়াটি নষ্ট করে দেয়।

রামদা সরবরাহ করেন যুবলীগ নেতা হানিফ : গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। গুরুতর আহত তিন শিক্ষার্থীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সাধারণ গ্রামবাসীর হাতে কখনো রামদা থাকার কথা নয়। সংঘর্ষের সময় যাদের হাতে এসব অস্ত্র ছিল, তারা বেশির ভাগই যুবক এবং অনেকের মাথায় হেলমেট ও গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা ছিল।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রামবাসীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু ক্যাডার। এরা যুবলীগ নেতা মো. হানিফ ও তার ভাই মো. ইকবালের অনুসারী।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ফতেপুর ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে হানিফের আধিপত্য চলছে। মাদক ব্যবসা, গাছ বিক্রি, চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল- সবকিছুতেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার বিরোধও বহু পুরনো। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর তার আধিপত্য কিছুটা কমলেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন এলাকার দোকান দখলকেন্দ্রিক বিরোধের জের ধরে গত বছরের ২১ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের ওপর তার অনুসারীরা হামলা চালায়। এতে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হন। এ ঘটনায় হানিফের গরুর খামার ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। হানিফকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনও করে। এসব ঘটনায় চবি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে হানিফ। গত শনিবার সংঘর্ষ শুরু হলে সেই সুযোগ নেয় হানিফ ও তার বাহিনী- এমনটা অভিযোগ করেছেন আহত একাধিক শিক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী মো. ঈসমাইল বলেন, এ হামলা ছিল পরিকল্পিত। হানিফের প্রভাবশালী বাহিনী অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। সাধারণ গ্রামবাসীর হাতে কখনো রামদা থাকতে পারে না। আহত আরেক শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান বলেন, হেলমেট আর গামছা পরা যুবকরা হাতে রামদা নিয়ে সামনে থেকে আমাদের কুপিয়েছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন হত্যার উদ্দেশ্যে এসেছে। আমার কবজিতে কোপ দিয়েছে। বেধড়ক পিটিয়ে আমার দুটি আঙুল ভেঙে দিয়েছে।

অস্ত্র ব্যবহারকারীদের শাস্তি চান জোবরা গ্রামবাসীও। সেখানকার বাসিন্দা সেকেন্দার আলী বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা চালানোয় আমরা প্রতিরোধ করেছি। ইটপাটকেল ছুড়েছি, হাতে লাঠি ছিল। তবে গ্রামবাসীর কারও হাতে রামদা ছিল না। কারা রামদা ব্যবহার করেছে, তা প্রশাসন খুঁজে বের করুক।

স্থানীয়রা জানান, হানিফের বিরুদ্ধে হাটহাজারীসহ বিভিন্ন থানায় ১০টির বেশি মামলা থাকলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, গ্রামবাসীর সঙ্গে মিশে রামদা হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ‘খুনের চেষ্টা’ করেছে হানিফের অনুসারীরা।

  • Related Posts

    জুলাই সনদ সই নতুন অধ্যায়ের সূচনা: মির্জা ফখরুল

    বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জুলাই সনদ সই বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ স্বাক্ষর শেষে…

    জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ৭ দফা অঙ্গীকার

    বহুল আলোচিত ‘ঐতিহাসিক জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকার করেছেন। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *