তাপস-খোকন বিরোধ তুঙ্গে
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গেল নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই নেতা ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের মধ্যে। এরপর নির্বাচন ও দায়িত্ব গ্রহণের সময় ভেতরে ভেতরে বিরোধ থাকলেও তা প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু সম্প্রতি ডিএসসিসির মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে পরস্পরের প্রকাশ্য অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও। গত শনিবার ডিএসসিসি মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে দেওয়া ব্যক্তব্যের জের ধরে সোমবার সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুটি মানহানি মামলার আবেদন করা হয়। এর আগে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন মেয়র তাপস। এর প্রেক্ষিতে সাঈদ খোকনও আইনি মোকাবিলা করার পাশাপাশি রাজপথে দেনা-পাওনা শোধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব। যুবলীগ প্রতিষ্ঠাতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য সাঈদ খোকন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র। তার বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গেল নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার মধ্যে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। মনোনয়নকে কেন্দ্র করেই মূলত তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। দায়িত্ব হস্তান্তরের দিন তৎকালীন মেয়রের উপস্থিত না থাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ নিয়ে সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সাঈদ খোকন। তাদের ভাষ্য খোকনের মেয়াদের শেষ দিন নতুন মেয়র দায়িত্ব বুঝে নিতে পারেন না। আর নিজের মেয়াদপূর্তির পর সাঈদ খোকনও ওই অনুষ্ঠানে থাকেননি। মেয়র তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচু্যত করা হয়। কিন্তু সরাসরি সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বললেও কমিশন বাণিজ্য, সিন্ডিকেট ভাঙাসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাপস। জানা গেছে, সম্প্রতি ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করতে গেলে দোকান মালিক সমিতির নেতারা সরাসরি সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেন। দোকান বরাদ্দ ও নকশাবহির্ভূত দোকান নিয়ে নানা অভিযোগে সাবেক এ মেয়রের বিরুদ্ধে মামলাও করেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু। গতকাল মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে নিয়ে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরীর আদালতে মামলা দুটি দায়ের করা হয়। এক মামলার বাদী কাজী আনিসুর রহমান। অন্য মামলার বাদী অ্যাডভোকেট মো. সারোয়ার আলম। বাদী অ্যাডভোকেট মো. সারোয়ার আলম মামলার অভিযোগে উলেস্নখ করেন, আসামি সাঈদ খোকন গত শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে জাতীয় ঈদগাহ গেটের সামনে ফুলবাড়িয়া মার্কেটের উচ্ছেদ হওয়া ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে তার বক্তব্যে বলেন, ‘তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলাবাজি করে চলেছেন, আমি তাকে বলব রাঘব-বোয়ালের মুখে চুনোপুঁটির গল্প মানায় না। কেননা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে সর্বপ্রথম তার নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। তারপর চুনোপুঁটিদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অথচ তিনি উল্টো কাজ করছেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর তাপস ডিএসসিসির শত শত কোটি টাকা তার নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন।’ অভিযোগে আরও উলেস্নখ করা হয়, গত রোববার আসামি সাঈদ খোকনের এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে ব্যারিস্টার শেখ ফলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ করে আসামি সাঈদ খোকন দন্ডবিধি আইনের ৫০০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অভিযোগে বাদী বলেন, মামলার বাদী গত রোববার বিকাল ৫টায় শাহবাগ থানায় হাজির হয়ে এজাহার দায়ের করতে চাইলে থানা কর্তৃপক্ষ এজাহার না দিয়ে আদালতে পিটিশন মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেন। এমতাবস্থায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ৫০০ ধারায় অপরাধ আমলে গ্রহণ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে জেলহাজতে আটক রাখার জন্য আবেদন করছি। আজ এ দুটি মামলা আমলে নেওয়ার বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আদালত। মামলা হওয়ার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় আইনি মোকাবিলার পাশাপাশি রাজপথে দেনা-পাওনার হিসাব হবে বলে জানিয়েছেন সাঈদ খোকন। গণমাধ্যমে পাঠানো তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, তাপসের মানসম্মানের বাজারমূল্য কত? মামলার পূর্ণাঙ্গ বিবরণী পেলে জানতে পারব। আইনি মোকাবিলার পাশাপাশি রাজপথে দেনা-পাওনার হিসাব হবে, ইনশাআলস্নাহ। এর আগে সোমবার সকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন। এ সময় তিনি বলেন, ১০ জানুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। তার আগের দিন ঘটা করে একটি সভা ডেকে আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়েছে। এটা আমার মনে হয় তার ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। মেয়র তাপস বলেন, ১৭ মে দায়িত্বভার গ্রহণের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ করেছি। সেখানে আপনারা লক্ষ করেছেন মার্কেট সংক্রান্ত কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেখানে বিভিন্নভাবে টাকা লেনদেন হয়েছে। যাদের সঙ্গে টাকা লেনদেন হয়েছে, যারা টাকা দিয়েছে তারাই অভিযোগ এনেছে। আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটির পক্ষ থেকে বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো সময় কোনো অভিযোগ করিনি। এখন তিনি পুরো দোষ আমার ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। সেটা আমি মনে করি খুবই অনভিপ্রেত এবং শুধু তার আক্রোশের বশবর্তী হয়ে তিনি এ বিষয়গুলো তুলে ধরছেন। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে পারি।