আনুশকার মৃতু্য রহস্য এখনো অন্ধকারে
রাজধানীর ধানমন্ডির কলাবাগানে স্কুলছাত্রী আনুশকাকে নির্জন বাসায় ডেকে নিয়ে কথিত বন্ধু দিহান শারীরিক সম্পর্ক করলেও তা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল কিনা- সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তাই এটি ধর্ষণ কিনা সে ব্যাপারে পুলিশ এখনো অনিশ্চিত। এ অবস্থায় ওই স্কুলছাত্রীর সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলে কেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলো এবং এটি তার মৃতু্য হতে পারে কিনা তা এখন পুলিশের কাছে প্রধান জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এ মৃতু্য রহস্য নিয়ে তারা এখনো ঘোর অন্ধকারে রয়েছেন। কেননা ওই স্কুলছাত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের আগে তার কথিত বন্ধু দিহান তাকে খাদ্যদ্রব্য বা পানীয়র সঙ্গে নেশাজাতীয় কিংবা উত্তেজক কোনো ওষুধ খাওয়েছিল কিনা সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তাই মূল তদন্ত এগিয়ে নিতে ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, স্পর্শকাতর এ মামলা তদন্তে তারা কোনোরকম বিলম্ব করতে চান না। তাই ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার আগেই তারা এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ের তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করা না হলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে কিনা? তাতে কারো মৃতু্য ঘটতে পারে- এ ব্যাপারে তারা একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলছেন। একই সঙ্গে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা এবং দিহান ও ওই স্কুলছাত্রীর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
কলাবাগান থানা পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দিহানের সঙ্গে ওই স্কুলছাত্রীর প্রেমের সম্পর্ক থাকার বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া স্কুলছাত্রীর মৃতদেহের ময়নাতদন্তে বিকৃত যৌনাচারের
\হআলামত পাওয়া গেলেও গোপনাঙ্গে আঘাত কিংবা ধর্ষণের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তাই স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে কিনা এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্তে সংশ্লিষ্টরা জানান, স্ত্রী রোগ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা তাদের জানিয়েছেন, অপ্রাপ্তবয়স্কর ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্কের সময় কোনো কোনো পরিস্থিতিতে প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রম্নত সঠিক চিকিৎসা নিলে জীবনহানির আশঙ্কা এড়ানো সম্ভব। যৌনাচারের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা বা বিকৃতিও মৃতু্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
এদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ মানুষের মৃতু্যর ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কারণগুলোর একটি বলে মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নূর সাঈদা। এই চিকিৎসক বলেন, ‘অপ্রাপ্তবয়স্কর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কারণে অনেক সময় রক্তপাত হতে পারে। এমন ভুক্তভোগী আমাদের হাসপাতালে প্রচুর ভর্তি হয়। সঠিক সময় রক্ত, স্যালাইন দিলে তারা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। ফলে রোগী বেঁচে যায়।’
তিনি বলেন, ‘শারীরিক সম্পর্ক বড়দের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হলেও অপ্রাপ্তদের জন্য এটা অস্বাভাবিক। কারণ, বাচ্চা মেয়েদের গোপনাঙ্গ ভালোভাবে ডেভেলপড হয় না। সেখানে জোর করলে স্থানটি ছিড়ে যেতে পারে। এই কারণেও রক্তপাত হতে পারে। এই ঘটনা ঘটলে দ্রম্নত সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি চিকিৎসক অধ্যাপক সালমা আক্তার মুনমুন জানান, তিন বছর আগে একই ধরনের একটি ঘটনার চিকিৎসা করেছিলেন। তবে দ্রম্নত হাসপাতালে আসায় মেয়েটি বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল। শারীরিক সম্পর্কে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার কারণে হাসপাতালে এসেছিল। সেই মেয়েটির যৌনাঙ্গ কিছু অংশ ছিঁড়ে গিয়েছিল, অপারেশন করে রক্ত বন্ধ করতে হয়েছিল। তবে সঠিক সময় হাসপাতালে আনার কারণে সে এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে।’ এই চিকিৎসক জানান, মেয়েদের গোপনাঙ্গ সংবেদনশীল হওয়ায় শারীরিক সম্পর্কের সময়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ক্ষত তৈরি হলে রক্ত বন্ধ হতে অনেক সময় লাগে। অনেক সময় অপারেশন করতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শিখা গাঙ্গুলী বলেন, ‘অনেক সময় শারীরিক সম্পর্কটা জোরপূর্বক করা হয়, এই ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের বস্নাড ভেসেল ছিঁড়ে যেতে পারে। এতে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। তবে সম্পর্কে যদি দুই জনের সম্মতি থাকে রক্তপাতের ঘটনা অনেক কম ঘটে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক নুসরাত আফরীন নীলা মনে করেন, যৌনাচারের কারণে প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ের মৃতু্য খুবই অস্বাভাবিক। এখানে অন্য কিছু থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘শারীরিক সম্পর্কের কারণে কোনো কোনো সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে মৃতু্য হতে পারে না, যদি না অন্য কিছু দিয়ে সেখানে আঘাত করা হয়।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, শারীরিক সম্পর্কের পর রক্তক্ষরণ হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে ট্রমা বা মানসিক আঘাত। অনেকেই শারীরিক সম্পর্কের সময় ভয় পান বা অনিচ্ছা থেকে মানসিক চাপ অনুভূত হয়। শারীরিক সম্পর্কের সময় সঙ্গিনীর অসম্মতি বা অনিচ্ছা থাকলে গোপনাঙ্গ শিথিল থাকে না। তখন বল প্রয়োগ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, সম্মতি নিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার পরও মানুষের মৃতু্য হতে পারে। তবে হার একেবারেই কম, মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। গোপনাঙ্গ নালিতে রক্তের অনেক ধমনী ও শিরা থাকে। এদের যেকোনো একটিও গুরুতর আঘাত বা ক্ষত এর ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এবং সময়মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন না হলে মানুষ মারা যেতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনা বিরল। এছাড়া শারীরিক সম্পর্কের সময় অনেক ক্ষেত্রে কোকেইন বা ভায়াগ্রার মতো ড্রাগস গ্রহণ করলেও মৃতু্য হতে পারে।