আতঙ্ক-উদ্বেগে যুক্তরাষ্ট্র
মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই একরাশ আতঙ্ক আর উদ্বেগ নিয়ে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মার্কিন নাগরিকরা। এদিকে, এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশটিতে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। দেখা দিয়েছে উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গদের নজিরবিহীন সহিংসতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং লুটপাটের আশঙ্কা। অনেক দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভোট শুরু হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানগুলোর মালিকরা সম্ভাব্য সহিংসতা এবং হামলা থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। সংবাদসূত্র : সিএনএন, বিবিসি, আল-জাজিরা
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শহরে ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন ও পরবর্তী দিনগুলোয় জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুরের ভয়ে ঘরবাড়ি ছাড়ছেন সাধারণ মার্কিনিরা। ‘ওয়ালমার্ট’ গত সপ্তাহে জানিয়েছিল, তারা তাদের স্টোরে সাময়িকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি, খোলা জায়গায় প্রদর্শন বন্ধ রাখছে। কারণ, তারা ‘গণঅসন্তোষের’ আশঙ্কা করছে। তবে একদিন পর তারা সেই সিদ্ধান্ত বদল করে।
এদিকে, সহিংসতা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করছে বিভিন্ন রাজ্য সরকার। রাজ্যে রাজ্যে, শহরে শহরে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে পুলিশ। রাজধানী ওয়াশিংটনের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে হোয়াইট হাউস ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে সহিংসতা ও ভাঙচুর থেকে নিজেদের সম্পদ সুরক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করছেন ব্যবসায়ীরা।
গত কয়েকদিন ধরে রাস্তার ধারের দোকানপাট ও ভবনগুলোর জানালা-দরজায় ও দেয়ালে দোকানিদের কাঠ এবং বোর্ড লাগাতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কিনা এবং ফল গৃহীত হবে কিনা- তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ভোটাররা। ইউএসএ টুডে ও সাফোক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ জরিপ মতে, চারজন ভোটারের মধ্যে তিনজনেরই আশঙ্কা, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা হবে। ফ্লোরিডার পিটার্সবুর্গের এক রেজিস্টার্ড নার্স বলেন, ‘এই মুহূর্তে খুব চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমি আমার পুরো জীবনে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি দেখিনি।’ এ ছাড়া, নির্বাচনের ভুয়া খবর ছড়িয়ে সহিংসতা হতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ। মার্কিন প্রশাসনকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘ভোট নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে আছি।’
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্ত-সংলগ্ন নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দারা সবার আগে ভোট দিয়ে নির্বাচনের সূচনা করেন। ভোটগ্রহণের প্রথম প্রহরে ভোট হওয়া রাজ্যটির এই দুই কেন্দ্রের ফল এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম। এর একটিতে সব ভোট পেয়েছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। আর অন্যটিতে বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ডিক্সভিল নচ শহরের একটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ ও গণনা শেষ হয় রাতের প্রথম প্রহরেই। এই কেন্দ্রে মাত্র পাঁচটি ভোট পড়েছে। আর তার সব ভোটই পেয়েছেন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন।
ওই এলাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভোটাররা সোমবার মধ্য রাতে ভোট দিতে ব্যালসামস রিসোর্টে যান। মঙ্গলবার রাতের প্রথম প্রহরে একটি কক্ষে গিয়ে প্রত্যেকে ভোট দেন। ডিক্সভিল নচ মাত্র ১২ জন বাসিন্দার একটি ছোট্ট শহর। ভোটগ্রহণের কিছুক্ষণের মধ্যেই কেন্দ্রের ফল জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এই কেন্দ্রের ফলের সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে কে সবচেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে যাচ্ছেন, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হতে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।
২০১৬ সালের নির্বাচনেও ডেমোক্রেট দলের প্রার্থীকেই বেছে নিয়েছিলেন এই শহরের ভোটাররা। সে সময় ট্রাম্পকে হারিয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখা গেছে, ট্রাম্পই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
এদিকে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের মিসফিল্ড নামের অন্য একটি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই কেন্দ্রেও মাত্র ২১টি ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ট্রাম্প পেয়েছেন ১৬টি এবং বাইডেন পেয়েছেন ৫ ভোট।
অঙ্গরাজ্যটির দুটি শহরের বাসিন্দারাই তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেওয়ায় অঞ্চলটির আরেকটি শহর হার্টস লোকেশন একই পথে হাঁটেনি। সেখানকার ৪৮ জন ভোটারকে এবার মধ্যরাতের পরিবর্তে দিনের বেলায় ভোট দিতে বলা হয়।
ওহিও এবং ফ্লোরিডার মতো কিছু অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনের দিনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই আগাম ভোটের গণনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী কেমন হচ্ছে, সেটির ওপর নির্ভর করে ভোটের রাতেই বিজয়ী ঘোষণা করা সম্ভব হয়।
কিন্তু পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিনের মতো কয়েকটি রাজ্যে ভোটগ্রহণের দিন ছাড়া আগাম ভোট গণনার সুযোগ নেই। এসব রাজ্য নির্বাচনী ফলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। দেশটির নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলছেন, ভোট গণনায় কয়েকদিন পর্যন্ত লাগতে পারে।
যেসব রাজ্যে আগাম ভোট প্রক্রিয়াকরণের জন্য নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়; সেসব রাজ্যে প্রাথমিক ফল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, রিপাবলিকানরা ভোটকেন্দ্রে স্বশরীরে হাজির হয়ে ভোট দেবেন বলে প্রত্যাশা করা হয় এবং এই ভোটগুলো দ্রম্নত গণনা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আগের সব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় এবারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এর কারণ, মহামারি করোনাভাইরাস। প্রতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতে শুরু করে ভোটগ্রহণের রাত থেকেই। পরের দিন পরাজিত পক্ষের বক্তব্যের মাধ্যমেই সিলমোহর পড়ে জনগণের রায়ে। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে এবার অনেক কিছুই বদলে গেছে।
এবার নির্বাচনে কে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন, সেটা জানতে কয়েকদিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির মোট ২৪ কোটি ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ১৯ কোটি। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই ভোটারদের মধ্যে ১০ কোটির বেশি এরই মধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন। এই আগাম ভোটের ফল পেতে বিলম্ব হতে পারে।
সাধারণত মঙ্গলবার নির্বাচনের রাতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল জানা যায়। একেক রাজ্যে ভোট শেষ হয় একেক সময়। দেশটিতে প্রথম ভোটগ্রহণ শেষ হয় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায়।
নির্বাচনের রাতেই সব ভোট গণনা শেষ করা সম্ভব না হলেও বিজয়ী ঘোষণার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট কে পেয়েছেন, সেটা মোটামুটি জানা যায়। অধিকাংশ গণমাধ্যম হিসাব-নিকাশ করে কোন্ প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন, সেটা জানিয়ে দেয়। তবে এই ফল চূড়ান্ত নয়, ধারণা মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতীয় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন না। রাজ্যগুলোতে জয়ের মাধ্যমে কোনো প্রার্থী ইলেক্টোরাল কলেজ প্রতিনিধি বেশি পেলে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
দেশটির প্রত্যেকটি রাজ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যা নির্ধারিত। মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ জন, প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ এবং সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ওয়াশিংটন ডিসির তিনজন প্রতিনিধিসহ দেশটিতে মোট ইলেক্টোরাল কলেজ প্রতিনিধির সংখ্যা ৫৩৮। হোয়াইট হাউসে যাওয়ার জন্য একজন প্রার্থীর অন্তত ২৭০ ইলেক্টোরাল ভোটের দরকার হয়।
অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় এ বছর বেশিসংখ্যক মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। ডাকযোগে অথবা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তারা ভোটের আগ্রহ দেখিয়েছেন। সাধারণত ডাকযোগের ভোট গণনা করতে সময় বেশি লাগে। কারণ, বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব ভোটের সত্যতা যাচাই করা হয়। বিশেষ করে স্বাক্ষর এবং ঠিকানা যাচাই না করা পর্যন্ত ভোট গণনা হয় না।